কাশ্মীরে দমনাভিযানের মুখে পদ্যের পঙক্তিও সংবরণ করতে হচ্ছে কবিদের

হিমালয় পর্বতমালার আড়ালে সূর্য ঢলে পড়া শুরু করতেই উঠে দাঁড়ালেন কবি। পড়ন্ত নরম রোদে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে নুড়ি-পাথর বিছানো নদীর পাড়ে নেমে এলেন। সন্তর্পণে তারপর তাকান চারদিকে, দেখে নেন কেউ তাঁকে লক্ষ্য করছে কিনা। এরপর স্রোতের দিকে তাকিয়ে পাঠ করেন বুকে চেপে রাখা এক কবিতার অংশ:
'নিষেধ মেনে এখানে উচ্চারিত সব শব্দ অনুগত
কাল যারা গর্বের সাথে কবিতার কালেমা পাঠ করতো
তাদের আজ চিবুকে চুমু খায় উদ্ধত ছুরির ফলা'
অথচ চিরকাল প্রতিরোধ আর বিপ্লবের কবিতা লিখেছেন আর গুণমুগ্ধদের শুনিয়েছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ ভাট। তাঁর দেশ কাশ্মীরের দুই অংশ ভারত ও পাকিস্তানের দখলে, এর মালিকানা দাবি করে দুই রাষ্ট্রই। ১৯৯০ এর দশকে যখন ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে অধিকৃত কাশ্মীর সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদে উত্তাল, তখন নিহত 'জঙ্গি'দের জানাযাতেও অন্তিম প্রশংসার পঙক্তি পাঠ করতেন ভাট।
এজন্য স্থানীয় সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র নামক নির্যাতন কুঠুরিতেও নিক্ষেপ করেছে। সেখানে বসেও কবিতা লিখতেন তিনি। অন্যান্য বন্দীদের সাথে তাকেও যখন দুহাত বেঁধে হাই-ভোল্টেজ বিজলীবাতির দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করা হতো, তখন কবিতা আউড়ে সহবন্দীদের শান্তনা আর শক্তি দিতেন।
মোহাম্মদ ভাট বলেন, ওই অন্ধ কুঠুরির প্রকোষ্ঠে একখানা কলম আর কাগজই ছিল আমার জন্য যথেষ্ট।
'মাধহোশ বালহামি' ছদ্মনামে দুই দশক পর আজ সঙ্গোপনে কবিতা লেখেন ও আবৃত্তি করেন জনাব ভাট।
তাঁর ভাষায়, গত ৩০ বছরে আমি ভিন্নমত কণ্ঠরোধের এমন নজির আর দেখিনি। "সবখানেই কবরিস্তানের শুনশান নীরবতা, যেন নীরবতাই আমাদের বর্তমান সংকটের সেরা দাওয়াই।"

দুই বছর আগে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা মর্যাদা কেড়ে নেয় মোদি সরকার। ৮০ লাখ কাশ্মীরি বঞ্চিত হয় স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক মর্যাদা থেকেও। সেসময়েই মোতায়েন করা সেনা সংখ্যা বাড়ানো হয়। সিংহভাগ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকাকে তখন থেকেই আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
তারই অংশ হিসেবে বেড়েছে মুক্তবাক দমনের আয়োজন। কর্তৃপক্ষ শত শত বছর পুরোনো এ অঞ্চলের কাব্য চর্চার ওপরও আরোপ করেছে অলিখিত এক নিষেধাজ্ঞা।
তিনজন কাশ্মীরি কবি মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানান, সম্প্রতি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার কারণে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের জেরা করেছে স্থানীয় পুলিশ।
প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিকটিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আরও এক ডজনের বেশি কবি জানান, বাড়তি নজরদারির কারণে তারা নিরুপায় হয়ে প্রতিবাদী কবিতা লেখা বন্ধ করেছেন। কেউ কেউ এখনও লিখলেও গুপ্তচরদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বহুদূরে জনশূন্য স্থানে গিয়ে সেই পঙক্তি আবৃত্তি করেন।
জাবিরাহ নামক এক নারী কবি বলেন, "সরকারের ইচ্ছা আর নিয়মের বাইরে আমরা এখানে নিশ্বাসও নিতে পারিনা। প্রতিবাদী স্বর রুদ্ধ করে, শোক প্রকাশের শেষ আশ্রয় কেড়ে নিয়ে আমাদের যেন শ্বাসরোধ করা হয়েছে।"
এখন কাশ্মীরের প্রতিটি সড়কের অসংখ্য সামরিক চেকপোস্ট আর সেনা উপস্থিতিই জাবিরার কবিতাকে প্রভাবিত করে:
'এই পথ চলে গেছে কোন সুদূরে, আবার ফিরে এসেছে এখানেই
তবু আমার নিঃশেষিত হৃদয়ের কুঠুরি রুদ্ধ
কাঁটাতারের বেড়ায়,
এভাবেই থাক, যতদিন না হৃদয় বিদ্রোহ করে
আমরা দুজনেই মুক্তি পাব
আর প্রাণবন্ত এই জাতিকে ছেড়ে চিরতরে চলে যাব সেই দিন'

তবে এ অঞ্চলের ধারাবাহিক সহিংসতা ও বিদ্রোহের ঐতিহ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে পুনর্জীবিত করতে চাইছে। কাশ্মীরের স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা অবশ্য এনিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।
বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার আগে জম্মু ও কাশ্মীর নামেই পরিচিত ছিল ভারত অধিকৃত এ অঞ্চলটি। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকদল বিজেপির শীর্ষ নেতা ও জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সাবেক উপ-মুখ্যমন্ত্রী নির্মল সিং বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় লালিত বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার অবসান চান সরকারি কর্মকর্তারা।
"কবি হোক বা অন্য কেউ, ভারতীয় ভূখণ্ডের অখণ্ডতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কাউকেই সহ্য করা হবে না। আপনি যদি 'আজাদি' বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার দাবি তুলতে চান, কখনোই সে অনুমতি পাবেন না। তবে ভারতীয় সংবিধানের আওতায় থেকে কথা বলতে পারবেন। কেউ আপনাকে বাঁধা দেবে না," নির্মল সিং বলেন।
তবে বিধিনিষেধের সংজ্ঞা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অবস্থান আরও কঠোর। এখানে কী লিখতে হবে, কীভাবে লিখতে হবে- সাংবাদিকদের সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয়। অনেকের ওপর দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতির কোন ঘটনা নিয়ে টুইটারে পোস্ট দেওয়া কিছু সাংবাদিককে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আনার হুমকিও দিয়েছে পুলিশ।
২০১৯ সালের পর থেকে ২,৩০০ জনের বেশি কাশ্মীরিকে কর্তৃত্ববাদী ও অধিকার খর্বকারী এ আইনের আওতায় জেলে পোরা হয়েছে। ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের মতেই, সন্ত্রাসবিরোধী আইনটির মাধ্যমে স্বাধীনতার (আজাদি) স্বপক্ষে স্লোগান দেওয়া থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক বক্তব্য পোস্ট করাকেও রাষ্ট্রদ্রোহে হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কাশ্মীরে এমনকি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-সমাবেশেও তাৎক্ষনিক বাঁধা দেয় পুলিশ। সাংবিধানিক মর্যাদা হরণ ও তারপর থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দমনাভিযানের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি ছিল গত ৫ আগস্ট, এদিন দোকানে তালা দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে হয় কাশ্মীরি দোকানিদের।
কিন্তু, তারপরই কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে সাদা পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তি লোহার রড ও কড়াত দিয়ে দোকানের শাটার ও তালা কাটতে থাকে, বাধ্য হয়েই তখন দোকান খুলতে হয় মালিকদের।

পুলিশের সাথেই এসেছিল সাদা পোশাকের এসব লোকজন। এক সাংবাদিক সেখানে পুলিশের উপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে একজন অফিসার তাঁকে জানান, পুলিশ এখানে দোকানিদের নিরাপত্তা দিতে এসেছে। আরেকজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের তাড়িয়ে দেন।
তাই আনুষ্ঠানিক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদেরও আজ উপায় নেই উপত্যকায়। অথচ এ অঞ্চল ছিল হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতার মিলনস্থল। সফেদ তুষার ঘেরা পর্বতচূড়া, স্বচ্ছ জলের হ্রদ আর চোখ ধাঁধানো বন্য ফুলের আদিগন্ত মাঠের এক স্বর্গরাজ্য এই কাশ্মীর।
বহু শতাব্দী ধরে কাশ্মীরি কবিতা ও রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তারপরও, লাল দাদের মতো ১৩ শতকের কবিকে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই নিজেদের বলে গ্রহণ করেছে। ১৪ শতকের সুফি সাধক শেখ নূর -উদ- দ্বীন সামাজিক সংস্কার ও ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার বাইরে অবস্থানের কবিতা লিখে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রসারে ভূমিকা রাখেন।
২০০১ সালে মারা যান কাশ্মীরি বংশভূত মার্কিন কবি আগা শহীদ আলী। তিনি এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কাব্যরীতিকে আবারো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে সমাদৃত হন। তাঁর কবিতার উপজীব্য ছিল ১৯৯০ এর দশকের সহিংসতা:
'হে দেশবাসী, আমি সুদূর থেকে তোমার জন্য লিখছি
অনেক দূরে আছি আমি, যারা বেঁচে আছে তাদের থেকে
যারা নেই তাদের থেকেও,
সেখানে সবাই পকেটে ঠিকানা নিয়ে ফেরে
যেন মরণের পর অন্তত বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে যায় লাশ'
কাশ্মীরি জঙ্গিরা ভারত থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। যেকারণে দশকের পর দশক ধরে সহিংসতা চলে আসছে। সশস্ত্র লড়াই বন্ধের পরও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এখনও আছে। জনসংখ্যার সিংহভাগের মধ্যে আছে তাদের প্রতি সমর্থন।
২০১৯ সালে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হয়। যার প্রেক্ষিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর সীমান্তে সংঘাত ঘটে। ওই বছরের গ্রীষ্মেই অধিকৃত কাশ্মীরে দমনাভিযান তীব্র করে ভারত।

অতি-সাম্প্রতিক এক অপরাহ্নে ২৬ বছরের কাশ্মীরি কবি জিসান জয়পুরি রাজধানী শ্রীনগরের উপকণ্ঠের এক পুরোনো কেল্লার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে তাঁর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, এখানেও উপজীব্য বহু বছরের চলমান সহিংসতা:
'জন্মভূমির বিক্ষুদ্ধ বাতাসের সওয়ার দূর্বিনীত হৃদয়
ঘুরে ফিরছে অসংখ্য বিষণ্ণ মৌসুম
এখানে-ওখানে দেখেছি কত রক্ততৃষ্ণা
পেয়েছি অশান্ত হৃদয়কে
পেয়েছি তাদের শোকের অশ্রুতে ডুবে থাকা প্রতিটি কোনায়'
জিসান জয়পুরি এক বিখ্যাত কাশ্মীরি কবির নাতি। ২০১০ সালে টিয়ারশেলের আঘাতে প্রতিবেশী ১৭ বছরের এক কিশোরকে মরতে দেখেন তিনি। সেদিন থেকেই এক তিক্ততার অনুভূতি নিয়ে বড় হয়েছেন। ঘৃণা করতে শেখেন স্কুলের পাঠ্য বইকে, যেখানে মনোরম এক পর্যটন অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা আছে কাশ্মীরের।
জিসান জানান, আগেকার দিনে কবিদের লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে হতো না।
"এখন আমরা নিজের কাছেই কবিতার পঙক্তি পাঠ করি, অথবা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে শোনাই। সরকার চায় না, আমরা মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেই, তাই আমাদের টুঁটি চেপে ধরেছে।"
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস