‘জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক, কিন্তু এর প্রভাব স্থানীয়’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবং সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের সূচনা কর্মসূচির যৌথ উদ্যোগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সোমবার ১৩ই ডিসেম্বর একটি কর্মশালা আয়োজিত হয়। কর্মশালায় প্রধান অতিথি এবং রিসোর্স পারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধিদপ্তরের মনিটরিং এন্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট পরিচালক নেতাই চন্দ্র দে সরকার।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আরও ছিলেন সুনামগঞ্জের জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ডিআরআরও) শফিকুল ইসলাম, সিলেটের ডিআরআরও নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ কামাল আহমেদ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান - জৈন্তিয়াপুর, শাহাব উদ্দিন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান - রুস্তমপুর, সিলেট প্রেস ক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, এবং সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)।
বিশ্বজিৎ কুমার রায়, সূচনার সিনিয়র ম্যানেজার, ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং কর্মশালাটিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগের একটি পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করেন, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এনজিও সমন্বয়ের আদেশের পরিপূরক। তিনি বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক, কিন্তু এর প্রভাব স্থানীয়। সুচনায় আমরা দুর্যোগ মোকাবেলার স্থানীয় উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি।" সুচনা জনসাধারণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সরকারের দুর্যোগ সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ (SoD) মেনে কাজ করে যাচ্ছে। এই কর্মশালার উদ্দেশ্য সুচনা কর্মসূচি থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং সাফল্য বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সাথে মতবিনিময়, যাতে সূচনার সেরা কাজগুলিকে অধিদপ্তর মূলধারায় সমন্বিত করতে পারে।
নেতাই চন্দ্র দে সরকার, ডিরেক্টর (এমআইএম), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সমন্বিত কৌশলের গুরুত্বের কথা বলেন এবং এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলির অবদানের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, "যদিও বিশ্ব নেতাদের দ্বারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে অভিহিত করা হয়, আমরা আমাদের জ্ঞানের ভিত্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। আমাদের সেরা অনুশীলনগুলি নথিভুক্ত করতে হবে যাতে সবাই আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে।"
পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশে দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ফ্রেমওয়ার্ক উপস্থাপন করেন এবং সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এবং সামনে যেসব পরিবর্তন আসছে, সে বিষয়ে জানান।
মোহাম্মদ আলী রেজা, ডেপুটি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর, সূচনা অনুষ্ঠানের কার্যক্রমের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দুর্যোগের মতোই অপুষ্টি এমন একটি সমস্যা যার সমাধান হতে হবে বহুক্ষেত্রীয় এবং সমন্বিত। বিশ্বজিৎ রায় সচেতনতা ও সক্ষমতা তৈরি করে কমিউনিটি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সুচনার কার্যক্রম তুলে ধরেন।
সূচনার ১৫-২০ সদস্যের পুষ্টিদলগুলি স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি করছে। আটটি উপজেলায় সূচনার কমিউনিটি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট (সিআরএ) থেকে উঠে এসেছে তৃণমূল পর্যায়ে দুর্যোগের প্রভাব। সএকজন কিশোরী মেয়ে জানিয়েছে টানা বৃষ্টির সময় মাসিকের কাপড়ের ন্যাপকিন ধুতে এবং শুকাতে সমস্যা হয়। একজন উপজেলা চেয়ারম্যান বলেছেন তার উপজেলার ৩০%0মানুষ বন্যার সময়ও দূষিত পুকুর এবং নদী থেকে প্রাকৃতিক উত্স থেকে পানি পান করে। আরেকজন ইউএনও দুর্যোগের একান্ত স্থানীয় রূপ বোঝার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
সূচনা সিলেট ও মৌলভীবাজারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। কর্মশালায় সূচনার দুইজন অংশ গ্রহণকারী চান ভানু বেগম এবং মিলি রানী দাস ভিডিওতে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
চান ভানু বেগম কোম্পানীগঞ্জের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন যেখানে প্রতি বছর বন্যায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, "সুচনার কাছ থেকে আমরা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য 1090 নম্বরে কল করার বিষয়ে জানতে পেরেছি। আমরা বীজ বপনের আগে এখানে বৃষ্টির পূর্বাভাষ জেনে নেই। আমরা আরও শিখেছি কীভাবে উঁচু মাদা এবং বস্তায় সবজি চাষ করতে হয়, যা আমরা বন্যার পানি আসার আগেই শুরু করে দেই।"
তিনি বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সাধারণ মানুষ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ তাদের সামর্থ্যের বাইরে। এগুলোই তারা পুষ্টিদলের পরিকল্পনায় তুলে ধরেছেন স্থানীয় সরকারের জন্য। তিনি সরকারকে বন্যার ঝুঁকি কমাতে তাদের বসতবাড়ির ভিত্তি উঁচু করার প্রকল্প হাতে নেওয়ার করার আহ্বান জানান।
মিলি রানী দাস তার বড়লেখায় একটি দর্শনীয় জলবায়ু-স্মার্ট মডেল খামার গড়ে তুলেছেন। তার গ্রামটি হাকালুকি হাওরের নিকটবর্তী একটি নিচু অঞ্চলে অবস্থিত যা বছরে ছয় মাস পর্যন্ত বন্যায় ডুবে থাকে। মিলি রানী দাস বলেন, সূচনা তাদের জলবায়ু-স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে বছরব্যাপী সবজি উৎপাদনে সহায়তা করেছে। এখন তারা বর্ষাকালে সবজি চাষ করতে পারছেন যা আগে অসম্ভব ছিল। শুষ্ক মৌসুমে আরও বেশি ফলন পাচ্ছেন তারা। তার মডেল ফার্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার গ্রামের আশেপাশের লোকেরা সুচনার প্রবর্তিত কৌশলগুলি কাজে লাগাতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, "আমরা আমাদের বাড়িতে উৎপাদিত সবজি খাচ্ছি এবং উদ্বৃত্ত বাজারে বিক্রি করছি।" ভিডিওতে উঠে আসে বর্ষাকালে তার প্লাবিত বাগানের চমকপ্রদক ফলন।
জৈন্তিয়াপুর উপজেলা চেয়ারম্যান জনাব কামাল আহমেদ বলেন, "সুচনার ক্লাইমেট-স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে আমার উপজেলার পাহাড়ি এলাকার মানুষ সবজি চাষ করছে যা আগে হত না।" রুস্তমপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জনাব শাহাব উদ্দিন সুচনার সাথে স্থানীয় ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ এবং প্রশমন পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি সরকারের কাছে সুনামগঞ্জের মতো রুস্তমপুরে বাঁধ নির্মাণের কথা বিবেচনা করে এ অঞ্চলের অনেক ছোট হাওরকে রক্ষা করার দাবি জানান।
অংশগ্রহণকারী পিআইওরা দলীয়ভাবে সূচনার জন্য তাদের সুপারিশ সমূহ লিপিবদ্ধ করেন। জনাব নিতাই চন্দ্র দে সরকার তার সমাপনী মন্তব্যে আয়োজকদের এই সুপারিশগুলিকে অধিদপ্তরের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব হিসেবে উপস্থাপন করতে বলেন। তিনি জানান, অধিদপ্তর এই সুপারিশ গুলিকে মাঠ পর্যায়ের নির্দেশে রূপান্তরিত করবে। সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি জনাব ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, তিনি মনে করেন হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে সূচনার অনুকরনীয় কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। সূচনার ডেপুটি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী রেজার ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।