সাহিত্য, চিত্রকলা, বিজ্ঞান: মৃত্যুর খতিয়ান

কোনো সন্দেহ নেই ২০২০-এ সবচেয়ে বেশি কাভারেজ পেয়েছে ফুটবল সম্রাট ম্যারাডোনার মৃত্যু, তারপর সম্ভবত পাওলো রসি। খেলা নয়, এই লেখাটিতে বাংলাদেশের বাইরে সাহিত্য চিত্রকলা ও বিজ্ঞানের প্রয়াত ক'জন ব্যক্তিবর্গের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।
বছরের শুরুতেই ৭ জানুয়ারি ৫২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন বেস্টসেলার স্মৃতিকথা প্রোজাক নেশন রচয়িতা এলিজাবেথ ওরজে।
প্রোজাক নেশন
প্রোজাক হচ্ছে ডিপ্রেশনের ওষধ ফ্লুক্সেটিনের একটি ব্র্যান্ড নাম। হার্ভার্ড কলেজ এবং ইয়েল ল স্কুলের মেধাবী ছাত্রী এলিজাবেথ ডিপ্রেশন থেকে বিভিন্ন ধরনের আত্মঘাতি কাজ করেছেন, যন্ত্রণা পেয়েছেন এবং মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালে প্রকাশ করা 'কনফেশনাল মেময়ার' ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে সমাদৃত হয়েছে তার প্রোজাক নেশন। তিনি একটি ঢেউ সৃষ্টি করতে পেরেছেন যে কোনো কিছু গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। তারপর প্রকাশিত হয়েছে আরও চারটি বই নেশাগ্রস্থ বিষন্ন তারুণ্যের জগত উঠে এসেছে তার লেখায়। ২০১৫ সারে ঘোষনা দিলেন তিনি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে ক্যান্সার। তাকে ডাবল মাস্টেকটমি- দুটো স্তনই অপসারণ করতে হলো। তিনি জানিয়ে দিলেন- তার যে স্তনাভাস পোশাকের উপর দিয়ে ফুটে উঠে তা মিথ্যে স্তন, তা যেন কাউকে বিভ্রান্ত না করে। এলিজাবেথ এরই মধ্যেই প্রেম করলেন, বিয়ে করলেন, ক্যান্সার এতোটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, একদিন আর ঘুম থেকে উঠতেই পারলেন না।
ম্যারি হিগিনস যখন প্যানএমের এয়ার হোস্টেস
ম্যারি হিগিনস ক্লার্ক ৩১ জানুয়ারি মারা গেলেন। ম্যারি হিগিনস ছিলেন মেগা বেস্টসেলার গ্রন্থের রচয়িতা। এটি বিস্ময়কর যে তার ৫১টি উপন্যাসের প্রত্যেকটি বেস্ট সেলার্স তালিকায় অবস্থান করেছে। ৩১ জানুয়ারি ২০২০ তিনি ৯২ বছর বয়সে ফ্লোরিডাতে মারা যান। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর দরিদ্র মায়ের সংসার চালাতে খুব কম বয়সে তাকে জীবিকার সন্ধানে নামতে হয়। হোটেলের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে সুইচবোর্ড অপারেটর, এয়ার হোস্টেস, কপি রাইটার বিভিন্ন পদে কাজ নিতে হয়। ষোল বছর বয়সে লেখা উপন্যাস ট্রু কনফেশন প্রত্যাখ্যাত হয়। র্যামিংটন ব্যান্ড এর বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ নিয়ে যাদের সহকর্মী হিসেবে পান পরবর্তীতে তাদের একজন গ্রেস ক্যালি হয়ে ওঠে হলিউডের হার্ট থ্রব, আর জোসেফ হেলার ক্যাচ-২২' উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হন।
ম্যারি হিগনিস ক্রাইম থ্রিলার লিখে বিখ্যাত হলেন পরে, তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইজ ওয়াচিং, অ্যা ক্রাই ইন দ্য নাইট, হোয়াইল, মাই প্রেটি ওয়ান স্লিপস, লাভস মিউজিক, লাভস দ্য ড্যান্স, রিমেম্বার মি ।
জর্জ স্টেইনার
জর্জ স্টেইনার ফ্লেঞ্চ-আমেরিকান সাহিত্য সমালোচক ও দার্শনিক ৯০ বছর বয়সে ৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেমব্রিজে মৃত্যুবরণ করলেন। তাকে বলা হয় নব্য রেনেসাঁর শেষ দিককার স্থপতি। তিনি জেনেভা, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ইহুদি হওয়ায় নাৎসিবাদের শিকার। বিপদাপন্ন ভাষা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন এবং বলেছেন: যখন একটি ভাষার মৃত্যু হয় পৃথিবীকে বোঝার এবং বিশ্বকে দেখার একটি পদ্ধতিরও মৃত্যু ঘটে।
লাইসেল মুয়েলার
লাইসেল মুয়েলার: ১৯৯৭ সালের কবিতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী কবি, জার্মান বংশোদ্ভুত, ২১ ফেব্রুয়ারি মারা গেলেন, তখন বয়স ৯৬ বছর। নাৎসি শাসনামলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনায় পালিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রে এলেন, তার বয়স তখন ১৫ বছর। শুরুতে অনেকদিন একজন আমেরিকান ডাক্তারের দফতরে রিসেপশনিষ্ট হিসেবে কাজ করেছেন। মেধা ও যোগ্যতা তাকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সুযোগ এনে দেয়। তার কাব্যগ্রন্থ নয়টি।
ক্লাইভ কাসলার
ক্লাইভ কাসলার ২৪ ফেব্রুয়ারি অ্যারিজোনার প্যারাডাইস ভ্যালিতে ৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। হেমিংওয়ে পরবর্তী কালে হেমিংওয়ে ধরনের জীবনযাপনের জন্য তিনি খ্যাতিমান। তার থ্রিলার গ্রন্থগুলো অন্ততঃ কুড়িবার নিউ ইয়র্ক টাইমস এর বেস্ট সেলার্স লিস্টে এসেছে। আর একটি কারণে তিনি বিশ্বখ্যাত, সমুদ্রের তলদেশের অভিযাত্রী হিসেবে তিনি কমপক্ষে ৬০টি ডুবে যাওয়া জাহাজের অবস্থান সনাক্ত করেছেন, চিত্র ধারণ করেছেন এবং পৃথিবীকে জানিয়েছেন।
ক্লাইভ কাসলারের অনুসন্ধানে আবিস্কার আরএমএস কার্পেথিয়া
সবচেয়ে বিখ্যাত জাহাজটি হচ্ছে আরএমএস কার্পেথিয়া, ১৯১২ সালে টাইটানিক ডুবে যাবার পর এই জাহাজটিই প্রথম উদ্ধার কাজে এগিয়ে এসেছিল।
উল্লেখ্য বাংলাদেশে জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানার অনেক বই ক্লাইভ কাসলারের বিভিন্ন উপন্যাস অবলম্বনে রচিত হয়েছে।
রুবেম ফনসেকা
রুবেম ফনসেকা ব্রাজিলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক ১৫ এপ্রিল ৯৪ বছর বয়সে বিদায় নিলেন। তিনি পুলিশের সেপাই পদে চাকরিতে ঢুকে নিজের পড়াশোনা ও দক্ষতার গুণে পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত হয়েছিলেন। সহিংসতা ও যৌনতার বাড়াবাড়ি রকমের প্রকাশ তাকে বিতর্কিত করে তুলেছিল। তিনি মনে করতেন যে কথা সাধারণ মানুষ এবং সাধারণ লেখক বলতে পারে না, সেই কথাই তাকে বলতে হবে। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস অগস্তো।
পার ওলোভ এনকুইস্ট
সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে অবমূল্যায়িত বড় লেখকদের একজন পার। তিনি সুইডিশ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক, ২৫ এপ্রিল ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেন। হাইজাম্পে দেশিয় রেকর্ডধারী, ১৯৬১-তে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করেন। নোবেল পুরস্কারের জন্যও প্রস্তাবিত হয়েছেন।
কার্লোস রুইস সাফোন
কার্লোস রুইস সাফোন স্পেনের সমকালীন সবচেয়ে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, ৫৬ বছর বয়সে ১৯ জুন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেছেন। মিগেল সার্ভেন্তোসের দোন কিহেতো'-র পর সবচেয়ে বিক্রয় সফল স্প্যানিশ উপন্যাস তার, দ্য শ্যাডো অব দ্য উইন্ড। এ কালের স্প্যানিশ লেখকদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক ৪০টি ভাষায় ৪৪টি দেশে অনূদিত হয়েছেন। তার বিখ্যাত আরো দুটি উপন্যাস হচ্ছে : দ্য প্রিজনার্স হেভেন, দ্যা অ্যাঞ্জেলস গেইম। বাংলাদেশেও তার সবচেয়ে বিখ্যাত বইটি অনুবাদ হয়েছে, শ্যাডে অফ দ্য উইন্ডের অনুবাদ করেছেন শওকত হোসেন।
রুথ ক্লুগার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যাবার আগে
রুথ ক্লুগার একটি স্মৃতিকথা লিখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তার সেই বই স্টিল অ্যালাইভ : অ্যা হলোকাষ্ট গার্লহুড রিমেম্বার্ড বহু ভাষায় অনূদিত। রুথ ৬ অক্টোবর ৮৯ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম অস্ট্রিয়ায় ভিয়েনাতে। হিটলারের বাহিনী যখন অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়, তার চিকিৎসক বাবা অবৈধ গর্ভপাতের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন। তার বয়স যখন ১০ বছর তাকে মায়ের সাথে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়, ক্যাম্প থেকে পালানোর চেষ্টা করার সময় তার বাবাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মহাযুদ্ধ শেষে মুক্তি পান, ১৯৪৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। ১৯৫২-তে এমএ এবং ১৯৬৭-তে পিএইচডি করে ক্লিভল্যান্ড, কানসাস, ভার্জিনিয়া ও প্রিন্সটনে জার্মান সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। স্টিল এলাইভ মূলত: তার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের স্মৃতিকথা।
এলিসন লুরি
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক ফিকশনে পুলিৎজার বিজয়ী ৩ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তিনি বেশ ক'টি নন ফিকশন ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করছেন। ফরেন অ্যাফেয়ার্স উপন্যাসটি তাকে ১৯৮৪ সালের পুলিৎজার এনে দেয়। তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ওয়ার বিটুউইন দ্য টেটস।
জন লা কারে
জন লা কারে ব্যক্তিগত জীবনের এম ১৫ ও এম ১৬-র গোয়েন্দা ছিলেন। তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর সেরা কটি গোয়েন্দা উপন্যাস, তিনি ৮৯ বছর বয়সে ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। শুধু গোয়েন্দা উপন্যাসই নয়, উৎরে যাওয়া সাহিত্যকর্ম হিসেবে তার উপন্যাসগুলোও অত্যন্ত সমাদৃত। তার প্রয়াণের সংবাদ ব্রাজিলের খ্যাতিমান লেখক পাওলো কোহেলো লিখেছেন 'জন লা কারে, আপনি শুধু মহান লেখক নন, আপনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। আপনি আপনার নতুন বাড়ি উপভোগ করুন। রেস্ট ইন পিস।
তার 'দ্য স্পাই হুই কেইস ইন ফ্রম দ্য কোল্ড' পৃথিবীর সেরা স্পাই থ্রিলারের একটি। তার প্রধান সবগুলো গ্রন্থই চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী যাদের মৃত্যু হয়েছে
২০২০ এ ৫ জন নোবেল বিজয়ী মারা গেছেন।
১. জ্যাক স্টেইনবার্গার ১৯৮৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জয়ী; মৃত্যু ১২ ডিসেম্বর।
২. মারিও মলিনা ১৯৯৫ সালে রসায়নে নোবেল জয়ী; মৃত্যু ৭ অক্টোবর ২০২০।
৩. আর্থার আশকিন ২০১৮ সারে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী; মৃত্যু ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০।
৪. মাসাতোশি কোশিবা ২০০২ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল জয়ী; মৃত্যু ১২ নভেম্বর, ২০২০।
৫. জন হুটন ২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, পরিবেশ বিজ্ঞানী
প্রয়াত বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন: আর্নল্ড স্পিলবার্গ, পার্সোনাল কম্পিউটার উন্নয়নের একজন অগ্রনায়ক; আর্নন্ড চিত্র নির্মাতা স্টিফেন স্পিলবার্গের পিতা। ফ্রান্সেস এলেন, প্রথম দিককার নারী কম্পিউটার বিজ্ঞানী, জন ফিনম্যান, অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট, উইলিয়াম ডেমেন্ট, ঘুম গবেষক এবং র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা রেম শব্দ তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। তাকুয়ো আওয়াগি, করোনাকালে ব্যবহৃত আধুনিক অক্সিমিটার তারই আবিষ্কার। ক্যাথেরিন জনসন, গণিতজ্ঞ, মহাকাশযানের অরবিটাল মেকানিক্স তিনিই প্রথম হিসেব করেন। ল্যারি টেজলার, কম্পিউটার বিজ্ঞানী; কাট, কপি, পেস্ট পদ্ধতি তিনিই আবিষ্কার করেন।
চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই--তবুও এই রচনায় স্পার্টাকাসের নাযক কার্ক ডগলাস এবং গন উইথ দ্য উইন্ড এর অলিভিয়া ডি হ্যাভিল্যান্ড এবং বন্ড সিরিজের বিখ্যাত বেশ কটি ছবির নায়ক শন কনোরির নাম উল্লেখ করছি।