মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস

আগাথা ক্রিস্টির বয়স যখন মধ্য-বিশ, তখন, ১৯১৬ সালে, তিনি লিখতে শুরু করলেন তাঁর প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস যা ছিল সত্যিকার অর্থে এক অসম্ভব প্রচেষ্টা; বাস্তবে, এই লেখাটি ছিল এমন এক প্রকল্প, যার প্রেরণা এসেছিল ক্রিস্টির অগ্রজ বোন ম্যাজের সঙ্গে করা প্রচণ্ড জেদ থেকে। গোয়েন্দা উপন্যাসে তিনি ব্যর্থ হবেন না- এই ছিল ক্রিস্টির জেদ।
সে সময় ক্রিস্টি বিয়ে করেন ব্রিটেনের রাজকীয় উড়ান সংস্থায় কাজ করেন এমন একজন কর্মকর্তাকে, আর তখন তিনি ইংল্যান্ডের টরকি'র হাসপাতালে কাজ করছিলেন প্রথমে নার্স হিসাবে, পরে সেখানকার ডিসপেনসারিতে যারা ওষুধ বানিয়ে সরবরাহ করত। ক্রিস্টি তারপর চাকরি নেন এমন এক প্রতিষ্ঠানে যেখানে বিষ উৎপাদিত হতো, তিনি এ কাজের সঙ্গে এমন মিশে যান যে বিষ তাঁর মনোজগতে এক বিশেষ কিছুর জন্ম দেয়, এবং এতে করে পরবর্তী ছয়টি দশক ধরে তিনি এমন সব কাহিনি লিখতে পারেন যেখানে এ কাজের অভিজ্ঞতা সবচে বেশি ভূমিকা পালন করে। নানাধরনের বিষ পরবর্তী জীবনে বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া গোয়েন্দা উপন্যাস লিখতে গিয়ে কাজে লেগে যায় তাঁর, যার মধ্যে আছে একদম প্রথম উপন্যাসটি- দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস, যে বইটি কয়েক মাস আগে প্রকাশের ১০০ বছরে পা রেখেছে।

গোয়েন্দা কথাসাহিত্যের স্বর্ণযুগ নামে পরিচিত সময়ে যা ১৯২০ থেকে ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত বিস্তৃত, সেখানে ক্রিস্টির 'স্টাইলস'-এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; উপন্যাসটি বহুকিছুকেই প্রভাবিত করতে পেরেছিল। ক্রিস্টির এ বইটি আমাদেরকে ক্যাপ্টেন আর্থার হেস্টিংসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। হেস্টিংস অসুস্থ এক সৈনিক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট থেকে ফিরেছেন এবং এসেক্স কাউন্টির স্টাইলস কোর্টের বাড়িতে অসুস্থতাজনিত ছুটির কিছুটা সময় কাটাবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন, যেখানে আছেন তার বালকবেলার পরিচিত সুহৃদ জন ক্যাভেনডিশ। কিন্তু এখানে শান্তিতে ছুটি কাটানো তার হল না, হঠাৎ এক রাতে খুন হলেন ক্যাভেনডিশের বৃদ্ধা ও ধনী সৎ মা- এমিলি। হেস্টিংস এ্ররকুল পোয়ারো'র কাছে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত-সহায়তা চাইলেন, এ্ররকুল পোয়ারো একজন অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা পুলিশ; যুদ্ধের আগে থেকে হেস্টিংস তাকে চিনতেন, সম্প্রতি তিনি এসেক্সে স্টাইলসের কাছেই শরণার্থী হিসাবে বাস করছিলেন।
গত শতকের পুরোটাই, এ্ররকুল পোয়ারোকে নিয়ে লেখা ক্রিস্টির ৩৩টি উপন্যাসের ১ম উপন্যাস 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'-এর অসংখ্য সংস্করণ ছাপা হয়েছে, কোনো কোনোটি অসম্ভব মার্জিত, এবং মনকাড়া, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ শিল্পীদের ভাবনা আমাদেরকে অবাক করে দেয়। উপন্যাসের শতবর্ষপূর্তিতে, তার বিভিন্ন সংস্করণের এমন কিছু উদাহরণ আমি সংগ্রহ করেছি, যা থেকে এ উপন্যাসের উদযাপনের বিস্তৃতি কিংবা বর্ণচ্ছটা বুঝতে পারা যায়।

জন লেইন (যুক্তরাষ্ট্র), ১৯২০ : উপন্যাসের কাহিনি যেভাবে এগিয়ে গেছে, তাতে করে 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'কে বৃটেনের প্রায় আধা ডজন প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯১৯ সালেই ক্রিস্টি তার উপন্যাসের ছাপা কপি দেখার সমস্ত আশা বাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি অবাক হয়ে যান জন লেইনের একটি চিঠি পেয়ে, যিনি ছিলেন লন্ডন-ভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা 'দ্য বোডলি হেড'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। লেন তার চিঠিতে ক্রিস্টিকে একবার তাঁদের সঙ্গে তাঁর পাণ্ডুলিপির ভবিষ্যৎ বিষয়ে কথা বলতে বলেছিলেন। লারা টমসন লিখেছেন, 'জন লেন আগাথা ক্রিস্টির প্রতিভা সম্পর্কে কিছু একটা আন্দাজ করেছিলেন। এই লেখক হারিয়ে যাবেন না বরং জ্বলে উঠবেন। লেইন খাঁটি জিনিস চিনতে পারতেন। ক্রিস্টির হতাশা ও আশাহীনতাকে তিনি দূর করে দিলেন, 'দ্য বোডলি হেড'-এর সঙ্গে আরও পাঁচটি বইয়ের ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হলেন তিনি; স্টাইলসের জন্য যে রয়্যালটির হার দেওয়া হয়েছিল তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি পরিমাণে, যা কোনও ক্ষেত্রে দশ শতাংশ ছিল দুই হাজারেরও বেশি কপি বিক্রির ক্ষেত্রে।

ক্রিস্টি লক্ষ্য করলেন লেইন চুক্তিটি এমনভাবে সম্পাদন করেছেন যেন তিনি আর মাত্র পাঁচটি বইই লিখবেন, কিন্তু তিনি আসলে তা কখনও ভাবেননি; তাকে আরও লিখতে হবে এ রকম তার কখনও মনেই হয়নি। স্টাইলস-কে তিনি ধারাবাহিকভাবে ১৮ পর্বে 'লন্ডন টাইমস উইকলি'-তে প্রকাশ করলেন, ১৯২০-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাপা হতে শুরু করলো। যুক্তরাষ্ট্রে, জন লিইনের প্রকাশনার অধীনে এ বছরের অক্টোবরে আত্মপ্রকাশ করেছিল মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস, 'বোডলি হেড' থেকে ১৯২১-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় যুক্তরাজ্যে সংস্করণ। প্রতিটি হার্ডব্যাক সংস্করণই বাজারে আসে ডাস্ট জ্যাকেটসহ, অলঙ্করণ করেন মার্কিন শিল্পী আলফ্রেড জেমস ডিওয়েই (১৮৭৪-১৯৫৮), প্রচ্ছদে দেখা যায় স্টাইলস কোর্টের বাড়ির সদস্যরা এমিলি'র শয়নকক্ষের বাইরের হলওয়েতে মোমবাতি হাতে জড়ো হয়েছেন। বইয়ের শক্ত বাঁধাইয়ের নিচে আরেকপ্রস্থ 'আর্ট ডেকো' ডিজাইনের বাদামী কাপড়ের মজবুত বাঁধাই ছিল।

জন লেইনের ন'পয়সার উপন্যাস (যুক্তরাজ্য), ১৯৩২ : ক্রিস্টির বইয়ের 'হার্ড কভার'গুলির দাম এমন ছিল যে পাঠকের পক্ষে সংগ্রহ করাটা বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে পড়ে, যেমনটা জেসিকা ডেভিস পর্টার লিখেছেন; কারণটি ছিল বইগুলোর অভিজাত ছাপাই বাঁধাই। এ অবস্থায়, লেইন এবং 'বোডলি হেড' তাদের 'ন'পয়সা'র (নাইনপেনি'র উপন্যাস) সিরিজের একটি বই হিসেবে 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'কে পুনর্মুদ্রণের চেষ্টা করেন যা ছিল উইলিয়াম জে লক-এর 'দ্য বিলাভেড ভ্যাগাবন্ড' (১৯০৬) এবং বেন ট্রাভার-এর রকারি নোটস (১৯২৩) সংস্করণের মতো সস্তা অলঙ্করণের পেপারব্যাক, কিন্তু তাদের সিরিজটিও পাঠকপ্রিয়তা পেতে ব্যর্থ হয়; জেসিকা ডেভিস পর্টার লিখেছেন- এ ব্যর্থতা স্বল্প সময়ের জন্য ছিল, কারণ, লন্ডনের অলঙ্করণশিল্পীর গুণেই বইটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে যিনি মূলত শিশুসাহিত্যের বইয়ের অলঙ্করণের কাজ করতেন; ক্রিস্টির বইয়ের দারুণ প্রচ্ছদ করেন তিনি যেখানে ছিল এমন এক রহস্যময় হাতের স্কেচ যা একটি খোলা আলমারির তাকের সামনে স্থির, আলমারির তাক ভর্তি অসংখ্য বিষভর্তি শিশিবোতল 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'কে পড়তে আগ্রহী করে তোলে।

পেঙ্গুইন (যুক্তরাজ্য), ১৯৩৫ : ক্রিস্টির বইয়ের পেঙ্গুইন সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল বিশেষত্ত্বহীন কিন্তু এই সংস্করণটিই ক্রিস্টির সাহিত্য-প্রচেষ্টার একটি অগ্রগতিকে নির্দেশ করে। ১৯৩৫ সালে, বোডলি হেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতার (যিনি এক দশক আগে মারা গিয়েছেন) ভাইপো অ্যালেন লেইন ওই সংস্থার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। অ্যালেন নিশ্চিত ছিলেন যে পেপারব্যাকের মতো সস্তা দামের বইগুলোকে হার্ডকভার সংস্করণের পাশাপাশি নিউজস্ট্যান্ড এবং ব্যস্ত রেলপথের ডিপোগুলিতে বিক্রয়ের জন্য রাখা যেতে পারে যাতে পথচলতি পাঠকের চোখে পড়ে, আর যাতে হার্ডকভার সংস্করণগুলোর বাজারও নষ্ট না হয়। তিনি দেরি করলেন না, ভাই রিচার্ড এবং জনকে সঙ্গে নিয়ে পেঙ্গুইনের আজ পর্যন্ত তুমুল জনপ্রিয়তা রেকর্ড গড়া মুদ্রণটি বাজারে ছেড়ে দিলেন। এই সিরিজের প্রথম ১০টি বই বাজারে এলো এমন এক আঙ্গিকে যাদের প্রচ্ছদে প্রধান্য পেল তিনটি ঘন রঙ এবং বইয়ের নামের লেটারিং করা হলো গিল সানস-সেরিফ বোল্ড ফন্টে, ১৯৩৫ থেকে সিরিজটি বিক্রয়ের জন্য ছাপা শুরু হলো।
সিরিজের ষষ্ঠ বইটি ছিল ক্রিস্টির 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস', ছাপা হলো ক্রাইম ফিকশনের জন্য নির্ধারিত সবুজ রঙে (সাধারণ কথাসাহিত্যের জন্য নির্ধারিত হলো-কমলা রঙ, জীবনীগ্রন্থের জন্য গাঢ় নীল)। সিরিজের প্রথম ১০ বইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় রহস্য উপন্যাসটি ছিল ডরোথি এল সায়ার্স-এর 'দ্য আনপ্লিজান্টনেস অ্যাট দ্য বেলোনা ক্লাব'। ১৯৩৬ সাল থেকে পেঙ্গুইন একটি আলাদা প্রকাশনা প্রতিস্থানে পরিণত হলো।

অ্যাভন মাসিক মার্ডার মিস্ট্রি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ১৯৪৪ : গ্লাসে বিষ প্রয়োগ এবং আততায়ীর কল্পিত মুখাবয়ব স্টাইলসের প্রচ্ছদকে ক্লিশে করে ফেলতে পারতো কিন্তু ১৯৪০-এর অ্যাভন সংস্করণ দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়, যেখানে হত্যাকারীর মুখ (পুরুষ না কি নারী- কে হত্যাকারী?) একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, এমন এক সূত্র নির্দেশ করে যেন হত্যাকারীকে চিনে নিতে তেমন সমস্যা না হয়, আমরা শুধু বুঝতে পারব কার হাত প্রাণঘাতী স্ট্রাইসিন পাউডার মিশিয়ে দিচ্ছে গ্লাসের পানীয়ে। কিন্তু প্রচ্ছদের এই শিল্পকর্মটিতে ভুল ছিল, কারণ ক্রিস্টির গল্পটিতে ঠিক এরকম কিছু ছিল না।
অ্যাভন (যুক্তরাষ্ট্র), ১৯৫১ : '৫০ এবং '৬০-এর দশকের প্যাপারব্যাকগুলো কুখ্যাত ছিল তাদের যৌনউত্তেজক প্রচ্ছদের জন্য, যেন এগুলো শুধু পুরুষদের জন্যই ছাপা হয়, মূল গল্পের সঙ্গে যার তেমন একটা মিল থাকতো না, থাকলেও প্রধান কিছু না। শিল্পী বেরি ফিলিপস (১৯২৪-১৯৬৯) দ্বারা চিত্রিত দৃশ্যটি পাঠককে ভুল নির্দেশ দেয় কিন্তু তিনি মনে করেন এমন একটি উত্তেজক প্রচ্ছদ হয়তো পাঠককে আকর্ষণ করবে, বিক্রি বাড়িয়ে দেবে।

প্যান (যুক্তরাজ্য), ১৯৫৫ : শেষ অবধি আমাদের এই গল্পের এ্ররকুল পোয়ারোকে দেখতে পাই প্যান সংস্করণের প্রচ্ছদে, যেভাবে ক্রিস্টি তাকে বর্ণনা করেছেন- অসাধারণ চেহারার ছোটখাটো এক মানুষ, যার উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির একটু বেশি, কিন্তু ব্যক্তিত্বে প্রখর। সব সময় একপাশে হেলিয়ে রাখা মাথাটি দেখতে হুবহু একটি ডিমের মতো এবং যার গোঁফ ছিল বৈশিষ্ট্যময়। ব্রিটিশ শিল্পী রজার হল (১৯১৪-২০০৬) এ্ররকুল পোয়ারোর প্রতিকৃতি কল্পনা করে এমনভাবে প্রচ্ছদটি করেছেন যেখানে পোয়ারো একটি কফির কাপের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন যে কাপটি এমিলির বিছানাতে পাওয়া গেছে, যাতে ধারণা হচ্ছে যে কাপটিতে কোনো কিছু গুঁড়ো করা হয়েছে।
গ্রেট প্যান (যুক্তরাজ্য), ১৯৫৯ : এই সংস্করণে অলৌকিক কিছু ঘটে! ১৯৫৫-এর 'প্যান' প্রচ্ছদ থেকে '৫৯-এর প্রচ্ছদে পোয়ারো ভিন্নরূপে দেখা দেন। এখানে তার চুল আছে, মানে বয়স এখানে কম; তবে গোঁফের মধ্যে একটা বিশেষ কিছু ব্যাপার প্রকাশ পেয়েছে যাতে করে পোয়ারো ভিন্ন এক অভিব্যক্তিতে হাজির। গ্রেট প্যান সংস্করণের এ্রকুল পোয়ারো সৃষ্টি হয়েছেন ব্রিটিশ শিল্পী জ্যাক কিয়ের হাতে, যিনি ক্রিস্টির আরও কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, এবং যিনি জন ক্রিসি, ভিক্তর কানিং এবং রস ম্যাকডোনাল্ড-এর মতো লেখকদের বইয়েরও প্রচ্ছদ করেছেন।

প্যান (যুক্তরাজ্য), ১৯৬৯ : '৬৯-এর প্যান সংস্করণের প্রচ্ছদ ছিল ফটোগ্রাফিক যেন রান্না করার মতো রহস্যময় একটা কিছু ঘটেছে, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- এক গুচ্ছ চাবি, চায়না কাপের টুকরো, কার্পেটে কিছু পড়ে থাকার আভাস; এমন কিছু অনুষঙ্গ, উপন্যাসের চতুর্থ পর্বে পোয়েরো যার মুখোমুখি হবে, কিন্তু এমন একটা কিছু প্রচ্ছদে নেই যা পাঠকদের ধাঁধায় ফেলে দেয়।
ব্যান্টাম (যুক্তরাষ্ট্র), ১৯৭৮ : কখনও কখনও সাধারণ একটি নকশাও মনকাড়া হয়ে ওঠে। ৮৫ বছর বয়সে, ক্রিস্টির স্বাভাবিক মৃত্যুর ঠিক দু'বছর পর বান্টাম বাজারে এনেছিল 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'-এর এমন একটি পেপারব্যাক সংস্করণ, যা ছিল একদমই সাদামাটা, যাতে ক্রিস্টিকে উল্লেখ করা হয় মিস পার্পল-এর লেখিকা হিসেবে, ১৯৭৬ সালে পার্পল সিরিজের সর্বশেষ 'স্লিপিং মার্ডার'-এর প্রচার উদ্দেশ্যে।

ব্যান্টাম (যুক্তরাষ্ট্র), ১৯৮১ : এই প্রচ্ছদটি অসামান্য। যদিও তিনি রেইমন্ড চ্যান্ডলার, এরিক এম্বলার, কিংসলি অ্যামিস, এবং জন ফাউলস-এর মতো লেখকদের উপন্যাসের প্রচ্ছদ করেছেন, তারপরেও অ্যাংলো-স্কটস চিত্রকর টম অ্যাডামস (১৯২৬–২০১৯) সম্ভবত সম্ভবত বিশ শতকের সেরা শিল্পী যার হাতে ক্রিস্টির প্রতিটি বইই অসামান্য হয়ে উঠেছে; আগাথা ক্রিস্টি'র পেপারব্যাকগুলোর শৈল্পিক প্রচ্ছদের জন্য তিনি সব সময়ই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ট্রায়ার্ড গ্রানাডা (যুক্তরাজ্য), ১৯৮২ : প্রচ্ছদে সরলতার উদাহরণ সব সময় ভালো হয় না। একজোড়া বিদেহি হাত, ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকা বিষ আর কালো পশ্চাতপট- যেন ক্লাসে জমা দেওয়ার জন্য কারও সাধারণ একটি ছবির মতো?
অ্যালবার্ট বনিয়ার্স (সুইডেন), ১৯২৬ : ক্রিস্টির 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'-এর সুইডিশ সংস্করণের নাম 'এ ডোজ অফ স্ট্রিকনিন', প্রচ্ছদে বিষের শিশিও আছে, আর আছে একটি চিরকুট, সম্ভবত একটি নোট— যা এই গল্পের চরিত্রদের ভিন্নভাবে তুলে ধরে। আবার, এমিলির হারিয়ে যাওয়া শেষ উইলও হতে পারে।

ল্য মাস্ক (ফ্রান্স), ১৯৩২ : দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস-এর ফরাসি প্রচ্ছদ গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রা দিতে তৎপর, যেন পোয়ারো তার কেসটিকে সমাধানের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, লেখক যেন পুরো উপন্যাস জুড়ে একটি রূপকথা বলে চলেছেন যেখানে এমিলির হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনও এক রহস্যময় নারীর হাত আছে।
মান্দাদোরি (ইতালি), ১৯৩৩ : আপনার মতো আমিও চিন্তায় পড়ে যাই, ইতালির প্রকাশক কেন বইটির নাম (স্টাইলস কোর্টের রহস্যময় অপরাধ) বদলে ফেললেন? এদিকে, আমরা আবারও প্রচ্ছদে একজন নারীকে পেলাম কিংবা বলা যায় তার রহস্যময় ছায়া যে হয়তো প্রবীণা এমিলির হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত হবে… অথবা হত্যায় তার যুক্ত থাকা মিথ্যাও হতে পারে বা নাও হতে পারে। সব মিলিয়ে প্রচ্ছদে রহস্যবার্তা ছড়িয়ে পড়ে।
এদিজোনি আর্গো (ইতালি), ১৯৩৩: সন্দেহ সৃষ্টির জন্য প্রচ্ছদে যতটা সম্ভব মৃত্যুর চিহ্ন দিয়ে দাও- এই ছিল শিল্পীর মনে, এমন কথা আমরা মনে করতেই পারি ১৯৩৩-এর এই ইতালিয় সংস্করণটি দেখে, কিন্তু তাই বলে এমন এক শুভ্রকেশী বৃদ্ধা? সে আর বেশিদিন বাঁচবে না বলে এমন এক বালিঘড়ি? শবাধার? অবশ্যই, কেন নয়! একমাত্র তিনিই এক আশ্চর্যজনক শিল্পী যিনি এই অদ্ভুত সম্মেলনে খুলি ও কঙ্কাল দেখানো থেকে নিজেকে সামলাতে পেরেছিলেন!

শের্জ (জার্মানি), ১৯৭০ এবং ১৯৮০ : জার্মান সংস্করণ দু'টির প্রথমটি এমন ভয় জাগানিয়া যে পোয়ারোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন তো মনেই হয় না, মনে হয় পাগলাটে গোয়েন্দা, কিন্তু তার সঙ্গে যে দাঁড়িয়ে আছে, কে সে? বইটি হাতে নিয়ে কিছুতেই যেন এই রহস্যের সন্ধান করতে পারি না, কল্পনাও না। এমনও নয় যে দ্বিতীয় প্রচ্ছদটিকেও ভাল বলা যাবে। হ্যাঁ, খেলার তাসগুলো এখানে কিছুটা আবেদন তৈরি করতে পারে, অন্তত রহস্য সন্ধানে তাসের মুখগুলো তো এক খেলাই। পোয়ারো কি ক্রস চিহ্নিত কার্ডটিকেই বেছে নেবে? কিন্তু সবগুলো মুখই তো পোয়ারোর।
এম. ময়েজরাচি (ইস্রায়েল), ১৯৭৩: দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস-এর হিব্রু সংস্করণের প্রচ্ছদের এই অনিন্দ্য সুন্দর স্বর্ণকেশী কি বারিয়ে ফিলিপস-এর ১৯৫১ সালের পেপারব্যাকের মতো নয়, যার জমকালো সজ্জায় ধনরত্নের মালকিনের ইঙ্গিত দেয়? সে কি এমিলি? তাই কি মনে হয় আপনাদের? এই প্রচ্ছদ সুন্দরী এক ধাঁধা, মায়া কিংবা কুহক যা এই গল্পের সঙ্গে মেলে না, অন্তত কেউ সহজে তাকে মেলাতে পারবে না। প্রচ্ছদে যে লোকটিকে দেখা যাচ্ছে তিনি যেন বিপদে পড়ে গেছেন সুন্দরীকে দেখে আর সিগার টানছেন।

পরিসংখ্যান আমাদের বলে যে আগাথা ক্রিস্টির বইগুলোর চেয়ে কেবলমাত্র বাইবেল এবং শেক্সপিয়ারের বইই বেশি বিক্রি হয়েছে, অনূদিত হয়েছে একশোরও বেশি ভাষায়, যার মাধ্যমে তিনি বিশ্বের সর্বাধিক অনুবাদিত লেখকে পরিণত হয়েছেন। ক্রিস্টির এ্ররকুল পোয়ারোই প্রথম যার কল্পিত অবিচুয়ারি প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রথম পাতায়।
অনুবাদ: এমদাদ রহমান
[জে কিংস্টন পিয়ার্স যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে দীর্ঘ দিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন যার আসক্তি অপরাধ, রহস্য এবং থ্রিলার কথাসাহিত্যের প্রতি, যিনি 'অপরাধ-কথাসাহিত্য' সম্পর্কিত 'দ্য র্যাপ শীট' নামের একটি ব্লগের সঙ্গে যুক্ত।]