বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরাবেন বাইডেন, কিন্তু ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কী সম্ভব হবে?

গত জুলাই মাসে ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহারের কাজ শুরু করে। জাতিসংঘের বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংস্থাটি চীনের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহতার তথ্য গোপন করেছে- এমন অভিযোগ তুলে নেওয়া হয় এ সিদ্ধান্ত। ২০২১ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা।
কিন্তু, ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিত হওয়ার দৌড়ে হেরে গেছেন নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে। নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার প্রচারণাকালেই অঙ্গীকার দিয়েছিলেন, তিনি হু' থেকে সরে আসার পদক্ষেপ বাতিল করবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য খাতে নেতৃত্বের আসনে নিয়ে আসবেন।
বাইডেন প্রশাসনের নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নীতির আলোকেই এমন বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেমন তিনি; প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনা-সহ ট্রাম্প আমলের বেশকিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সিদ্ধান্তকে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন।
এনিয়ে বিশেষজ্ঞরা যেমন আশার কথা শোনাচ্ছেন, ঠিক তেমনি মার্কিন নেতৃত্ব কতটা কার্যকর হবে- তা নিয়েও প্রশ্ন রেখেছেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক রিফাত আতুন বলেন, ''সন্দেহ নেই বাইডেন আমলে হু'র সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আবারও আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। কিন্তু, সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া মানেই সবকিছু ঠিকঠাক হওয়া নয়। আগের মতো সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় অনেক সময়ক্ষেপণ যেমন হবে, ঠিক তেমনি সহসাই স্বাস্থ্যখাতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার আশা করতে পারে না যুক্তরাষ্ট্র।''
ট্রাম্পের করা অপূরণীয় ক্ষতি কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে, তার জন্য জানতে হবে কিছু প্রশ্নের উত্তর।
মার্কিন তহবিলের ঘাটতি কী হু'কে সঙ্কটে ফেলেছে?
ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল হু'র সবচেয়ে বড় দাতা। যেমন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংস্থাটিকে ৮৯ কোটি ডলারের বেশি অনুদান দেওয়া হয়। তাই সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই সংস্থাটিকে দেওয়া তহবিল ঘাটতির শঙ্কা করেছিলেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
সদস্যপদের চাঁদা বাবদ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হু'র পাওনা ৯ কোটি ডলার।
তবে অন্যান্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলে যে ঘাটতি দেখা দেবে- তা পূরণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, বলে জানান জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আইন বিভাগের অধ্যাপক লরেন্স গস্টিন। এই বিশেষজ্ঞ হু'র স্বাস্থ্য আইন বিভাগের পরিচালক হিসাবেও কাজ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িক অনুপস্থিতি সমস্যা নয়। তবে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি মারাত্মক আকারের তহবিল সঙ্কট তৈরি করতো বলে জানান তিনি।
অর্থ সমস্যা না হলেও বৈজ্ঞানিক সহযোগীতায় কী ব্যাঘাত ঘটেছে?
এব্যাপারে জানিয়েছেন, কায়জার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক জেনিফার কেটস। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন ট্রাম্পের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে।
তার সঙ্গে একমত পোষণ করে গস্টিন বলেন, ''ওই সিদ্ধান্ত হু'র সঙ্গে আমাদের দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞ সংস্থাটিতে সহযোগী হিসাবে কাজ করতেন। আমাদের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা- সিডিসি এবং অন্যকিছু প্রতিষ্ঠান সেখানে জড়িত ছিল। মহামারি মোকাবিলার পরিকল্পনা নিয়েও তারা একযোগে কাজ করেছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এই সহযোগিতার মাঝখানে অনাস্থার দেওয়াল তুলে দেয়।''
ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত শুধু চলমান মহামারি মোকাবিলায় নয়, পৃথিবীর গণস্বাস্থ্যের অন্যান্য বিষয়েও মার্কিন সম্পৃক্ততাকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলে জানান গস্টিন।
উদাহরণস্বরূপ তিনি হু'র সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন তৈরির একটি গবেষণা কেন্দ্রের কথা উল্লেখ করেন। বর্তমানে ওই স্থাপনায় সকল ধরনের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বন্ধ আছে। মহামারির মধ্যে অবিশ্বাস্য হলেও, এমন কাজই করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। বাইডেন উদ্যোগ নিলেও অসহযোগিতার এসব ক্ষেত্র কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
তাছাড়া, দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগও অনেক কমে গেছে বলে জানান কেটস। এক্ষেত্রে গত জুনের একটি সংবাদের কথা উল্লেখ করেন। প্রো-পাবলিকায় প্রকাশিত ওই সংবাদ সূত্রে জানা যায়, জাতীয় নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির মারাত্মক সঙ্কট ছাড়া- হু'র সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল।
যুক্তরাষ্ট্র কী বৈশ্বিক নেতৃত্ব ফিরে পাবে?
সদস্যপদ প্রত্যাহারে নেওয়া ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণে জনস্বাস্থ্য খাতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার স্থান হারিয়েছে, বলে জানান কেটস এবং গস্টিন। অথচ গত কয়েক দশক ধরে এখাতে যুক্তরাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তগুলোকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে।
ঐতিহাসিকভাবে দেশটি যেকোনো বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থায় সবচেয়ে বেশি অর্থ এবং কূটনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছে বলে জানান কেটস।
''এখন জীবাণুকে নয়, বলা হচ্ছে মূল সমস্যা হচ্ছে হু'। ট্রাম্প তার সমর্থকদের একথা বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছেন। মার্কিনীদের এই নেতিবাচক মনোভাব দুনিয়া জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে একটা তীব্র নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। অনেক দেশের সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রকে এই খাতে সহযোগী হিসেবে দেখছে না। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসন নিয়মিত নিজেদের ব্যর্থতা ও অবহেলা ঢাকতে হু'কে দোষারোপ করেছে,'' কেটস বলছিলেন।
এর মাধ্যমে মহামারি থেকে জনতার নজর অন্যদিকে আকর্ষণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে বিশ্ব এসব কিছু প্রত্যক্ষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতি এবং তার ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়েও শঙ্কিত। আগামীতে যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক ভূমিকা নিতে চাইলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপে দেশটি কতটুকু সহযোগী হতে পারবে, তা নিয়েও অনাস্থা বাড়ছে।
- সূত্র: এনপিআর